কজন সখিনা বেগম,অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়সের ছোটখাটো শীর্ণকায়া সখিনা বেগমের বাঁ স্তনের চাকাটা যখন ছয় মাস পর দগদগে ঘায়ে পরিণত হলো, তখন বস্তিবাসীর পরামর্শে সরকারি ক্যান্সার হাসপাতালে নিয়ে গেলেন সবজি বিক্রেতা হাঁপানি রোগে আক্রান্ত স্বামী আনসার আলী। ক্যান্সারবিশেষজ্ঞ যত্ন নিয়েই দেখলেন। তবে ব্যাখ্যা করে তেমন কিছু বললেন না। সবচেয়ে কম খরচ হয় এমন তিনটি ইনজেকশন বিশেষ পদ্ধতিতে সারা দিন ধরে শিরায় দেওয়ার পরামর্শ লিখে দিলেন। ছয়বার দিতে হবে, তিন সপ্তাহ পর পর। প্রতিবারের খরচ আড়াই হাজার টাকা। তার ওপর প্রতিবার ইনজেকশনের আগে রক্তের একাধিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। প্রথম ইনজেকশনের অর্থ জোগাড় হলো ধার-দেনা করে। দ্বিতীয়টির ব্যবস্থা হলো তিন সপ্তাহের পরিবর্তে দুই মাস পর, তার পর থেকেই বন্ধ।
এরপর কিছুদিন কেটে গেছে। হঠাৎ কারও মারফত ক্যান্সার রোগীদের জন্য একটি ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ কেন্দ্রের সন্ধান পেয়ে আনসার আলী সখিনাকে নিয়ে গেলেন সেখানে। কিন্তু তত দিনে আরোগ্য অযোগ্য পর্যায়ে পৌঁছে গেছেন সখিনা বেগম। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তার সামনে মিনতি করে স্বামী বলেছিলেন, ‘বারোটা বছর হে আমার লগে ঘর করছে, আমার ওপর হের তো একটা হক আছে স্যার, কন-আছে না? স্যার আপনেরা এই ইনজেকশনগুলার একটা ব্যবস্থা কইরা দেন। ডাক্তার কইছে হে ভালা হইয়া যাইব।’ প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত নীতিমালার বাইরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের যৌক্তিক বিধান অগ্রাহ্য করে খানিকটা আবেগতাড়িত হয়েই প্রতিষ্ঠানটি কেমোথেরাপির খরচ বহন করে। শুধু তা-ই নয়, পরবর্তী সময়ে অপারেশন এবং অপারেশন-পরবর্তী রেডিওথেরাপির খরচটুকুও বহন করেছিল তারা।
অপারেশনের চার মাস পর আবার একটি ক্যান্সার ক্ষত এবং ডান স্তনে আরেকটি চাকার আবির্ভাব নিয়ে বস্তির সামনে একটি চলন্ত ট্রাকের ধাক্কায় মারা যান সখিনা বেগম। বস্তিবাসীর কাছে জানা যায়, সকালে দুর্বল শরীরে সাহায্যের আশায় যখন তিনি প্রতিবেশীদের বাসায় বাসায় যাচ্ছিলেন, তখন রীতিমতো টলছিলেন তিনি। শেষের কটা দিন তীব্র যন্ত্রণায় সারা রাত কাতরাতেন, প্রতিবেশীদের কাছে ছেঁড়া কাপড় খুঁজতেন ঘা ঢেকে রাখার জন্য। আর এরই মধ্যে যার-তার কাছে নিজের মেয়েটির বিয়ের একটা ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাতেন বারবার। অথচ দুর্গন্ধের জন্য স্বামী, মেয়েও যেন খানিকটা দূরেই রাখত সখিনাকে।
অপারেশনের পর সরকারি হাসপাতালে ১০ দিন রেডিওথেরাপির জন্য এক হাজার টাকা তাঁর স্বামীর হাতে দেওয়া হয়েছিল। পরে জানা যায়, তিনি তাঁর স্ত্রীকে সেটা আর জানাননি এবং হাসপাতালেও নিয়ে যাননি।
বহুল উচ্চারিত এই অনুমিত পরিসংখ্যানকে বিশ্ব পরিসংখ্যানের সঙ্গে যৌক্তিকভাবেই মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। ২০০০ সালের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী সমগ্র বিশ্বে এক কোটি ছয় লাখ ক্যান্সারের রোগী ছিল, যা ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়াবে এক কোটি ৫৩ লাখ এবং ২০৫০ সালে দুই কোটি ৩৮ লাখ! গবেষকেরা ধারণা করেন, তখন উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা জনসংখ্যানুপাতিক হারের কারণেই বেশি থাকবে, যা হবে প্রায় এক কোটি ৭০ লাখ।
বাংলাদেশের একমাত্র জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ২০০৫ সালের সমীক্ষায় একটি মূল্যবান উপাত্ত রয়েছে। এ বছর যে সাত হাজার ৬১৬ জন রোগী এ হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার জন্য পেঁৗছাতে পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগেরও অধিক পরিবারের মাসিক আয় পাঁচ হাজার টাকার নিচে। অর্থাৎ স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো অর্থে ব্যয়বহুল ক্যান্সার চিকিৎসার আর্থিক সক্ষমতা তাদের নেই।
আরোগ্যনির্ভর চিকিৎসাব্যবস্থায় রোগী ও পরিবারের সবাই নিরাময় খোঁজেন যেকোনো মূল্যে, সবকিছুর বিনিময়ে। তাই একটি জীবন যখন ক্যান্সারের মতো ঘাতক ব্যাধিতে আক্রান্ত, একটি পরিবার যখন সংকটগ্রস্ত, তখন সবাই মিলে দিশেহারা। ধার-দেনা, হালের গরু, ফসলি জমি অথবা বসতভিটা বিক্রি করে নিঃস্ব হয়ে একসময় হয়তো শুনতে হয় ‘আর কিছু করার নেই, বাড়ি নিয়ে যান; অথবা আরোগ্যের মিথ্যা আশা নিয়ে অনিশ্চয়তার ভেতরই অনেক কষ্ট নিয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সেই সঙ্গে মৃত্যুবরণ করে পরিবারের, সন্তান-সন্ততির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। অনেক ক্ষেত্রেই পথে বসে নিঃস্ব পরিবার। কেন এমন হয়? রোগীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে পরিবারের ভবিষ্যৎ, সন্তানদের সম্ভাবনার এই অকালমৃত্যুকে রোধ করার কি কোনো উপায়ই নেই? চিকিৎসাব্যবস্থার কি এ ব্যাপারে কোনো সামাজিক দায়বদ্ধতা নেই?
যেখানে চিকিৎসা একটি ‘পণ্য’, সঠিক অর্থে বোধহয় ‘সেবা’ নয়। যত রোগী এই আরোগ্য নামের পণ্যটি কিনতে বারবার চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হন, ততবার চিকিৎসক, ওষুধ কোম্পানি ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান মুনাফা অর্জন করে।
আমাদের মতো শ্রেণীবিভক্ত দেশগুলোতে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো চিকিৎসা প্রদানকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মানসিকতা। তারা ধরে নেয় সেবাগ্রহীতার চেয়ে তারা উঁচু আসনে সমাসীন। প্রায় সব চিকিৎসকের চেম্বারে তার আসনব্যবস্থা, বাচনভঙ্গি-সবকিছুর ভেতরই যেন একটা প্রভুত্ব, কর্তৃত্বের পরিচয় ফুটে ওঠে। ‘রোগীকে সেবা করার সুযোগদানের জন্য চিকিৎসক কৃতজ্ঞ’-এই আপ্তবাক্যটি বিনামূল্য ও স্বল্পমূল্যের প্রতিষ্ঠানগুলোতে একটি প্রহসনে পরিণত হয়।
বাংলাদেশে যদিও প্যালিয়েটিভ কেয়ারের ধারণা ও উদ্যোগ এখনো ভ্রূণ পর্যায়ে রয়েছে; কিন্তু এর বিস্তার এবং সফলভাবে এর চর্চা ও ব্যবস্থাপনা হ্রাস করতে পারে নিরাময়-অযোগ্য রোগে আক্রান্ত অন্তিমশয্যায় শায়িত রোগীদের শারীরিক বেদনা, জোগাতে পারে মানসিক সমর্থন, স্বস্তি ও বাস্তবকে মেনে নেওয়ার শক্তি, আধ্যাত্মিক শান্তি।
আর সেই সঙ্গে রোগীর পরিবারের জন্যও সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। রবার্ট টুয়াইক্রিসের ভাষায় যা হলো এটি তাদের জীবনে নতুন দিন আনে না; কিন্তু তাদের প্রতিটি দিনে যোগ করে নতুন জীবন।
0 মন্তব্যসমূহ